দখিনের খবর ডেস্ক ॥ সরকার গ্রামাঞ্চলের শতভাগ মানুষের নিরাপদ পানি নিশ্চিতের উদ্যোগ নিয়েছে। ওই লক্ষ্যে শতভাগ নিজস্ব অর্থায়নে প্রায় ৯ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে সরকার গ্রামাঞ্চলে ‘নিরাপদ পানি সরবরাহ’ নামে একটি প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে। গত বছরের জানুয়ারি থেকে ওই প্রকল্পের কাজ শুরু হয়ে আগামী ২০২৫ সালের মধ্যে তা শেষ হওয়ার কথা রয়েছে। প্রকল্পটি বাস্তবায়ন হলে সারাদেশের গ্রামাঞ্চলের মানুষ নিরাপদ পানি পাবে। ফলে গ্রামাঞ্চলের মানুষের জীবনমান উন্নত হবে। বর্তমানে একটি নলকূপ বা নিরাপদ পানির উৎস ৮৭ জন ব্যবহার করছে। ফলে সবার জন্য নিরাপদ পানি নিশ্চিত হচ্ছে না। তবে প্রতি ৫০ জন একটি নলকূপ ব্যবহার করলে নিরাপদ পানির নিশ্চয়তা তৈরি করা সম্ভব হবে। ওই লক্ষ্য পূরণেই সরকার সারাদেশে নলকূপ বা নিরাপদ পানির উৎস তৈরি করার জন্য ৮ হাজার ৮৫০ কোটি টাকা ব্যয়ের ওই প্রকল্পটি হাতে নিয়েছে। জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদফতর সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা যায়। সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, গ্রামাঞ্চলে নিরাপদ পানি সরবরাহ প্রকল্পের একটি গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য হচ্ছে প্রকল্প বাস্তবায়ন মনিটরিং বা তদারকি। সেজন্য একটি এ্যাপস তৈরি করা হয়েছে। ওই এ্যাপসের মাধ্যমে হেড কোয়ার্টার থেকে সারাদেশের কাজ মনিটরিং করা হচ্ছে। কোথায় কতোটুকু কাজ হচ্ছে তা প্রধান অফিস থেকেই দেখা যাচ্ছে। বাংলাদেশে এই প্রথম তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহার করে একটি প্রকল্পের মাঠ পর্যায়ের কার্যক্রম মনিটরিং করা হচ্ছে। প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করছে স্থানীয় সরকার পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের অধীনস্থ প্রতিষ্ঠান জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদফতর। গত ২০২০ সালের ৭ জানুয়ারি প্রকল্পটি একনেকে অনুমোদন লাভ করে। আর প্রশাসনিক অনুমোদন পায় ২০২০ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি। প্রকল্পের উদ্দেশ্য হলো সারাদেশে নিরাপদ পানি সরবরাহ বৃদ্ধির মাধ্যমে জনগণের স্বাস্থ্য ও জীবনমান উন্নয়ন করা। সূত্র জানায়, জনগণের স্বাস্থ্য ও জীবনমান উন্নয়নে গ্রামীণ এলাকায় প্রয়োজনীয় সংখ্যক নিরাপদ পানির উৎস স্থাপনের লক্ষ্যে সমগ্র দেশে নিরাপদ পানি সরবরাহ প্রকল্পটি নেয়া হয়েছে। কাজটি শুরু করেছে স্থানীয় সরকারের জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদফতর। জাতীয় নিরাপদ পানি সরবরাহ ও স্যানিটেশন নীতিমালা ১৯৯৮-এর লক্ষ্য হলো গ্রামাঞ্চলে নলকূপের সংখ্যা বৃদ্ধির মাধ্যমে পর্যায়ক্রমে প্রতিটি নলকূপের জন্য ব্যবহারকারীর সংখ্যা ১০৫ থেকে ৫০ জনে কমিয়ে আনা। নীতিমালা অনুযায়ী গ্রামাঞ্চলে নলকূপের সংখ্যা বৃদ্ধির মাধ্যমে প্রতিটি নলকূপের জন্য বর্তমান ব্যবহারকারীর সংখ্যা ৮৭ থেকে ৫০ জনে হ্রাস করা প্রয়োজন। কিন্তু বহুমুখী চ্যালেঞ্জের মুখে নিরাপদ পানি সরবরাহ কভারেজ বৃদ্ধি করা খুবই কঠিন। কারণ বিশুদ্ধ পানি প্রাপ্যতা (ভূগর্ভস্থ ও ভূ-উপরিস্থ উভয়ই) দিন দিন কমে আসছে। আর্সেনিক ও অন্যান্য রাসায়নিক পদার্থের উপস্থিতি ভূগর্ভস্থ পানিকে দূষিত করছে। তাছাড়া উপকূলীয় অঞ্চলে অগভীর একুইফার (ভূগর্ভস্থ সিক্ত শিলাস্তর) এলাকায় লবণাক্ততা, দুর্গম অঞ্চলে শুষ্ক মৌসুমে পানির স্তর নেমে যাওয়া, কিছু কিছু এলাকায় কোন ধরনের পানির উৎস স্থাপন সম্ভব না হওয়া ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য সমস্যা পানি সরবরাহ ব্যবস্থাকে আদর্শ লক্ষ্যে পৌঁছাতে বাধাগ্রস্ত করছে। একই সঙ্গে জনসংখ্যা বৃদ্ধির কারণে পানির বর্ধিত চাহিদার বর্তমান পরিস্থিতি সামাল দিতেও বিপুল পরিমাণ পানি সরবরাহের প্রয়োজন। আর গ্রামীণ জনগণের শহরে অভিবাসন ও দ্রুত নগরায়ণে ওই প্রয়োজনীয়তাকে বহুগুণে বাড়িয়ে দিয়েছে। এমন প্রেক্ষাপটে নীতিমালার নির্ধারিত মানদন্ড অর্জন করতে বড় পরিসরে পদক্ষেপ গ্রহণ জরুরি। পিএন্ডসি বিভাগ, ডিপিএইচইর ২০১৭ সালের ডিসেম্বরের প্রতিবেদন অনুযায়ী বর্তমানে সারাদেশে চালু নলকূপের সংখ্যা ১৫ লাখ ৩৪ হাজার ৪৬০টি। এই অবস্থায় প্রতি ৫০ জনের জন্য একটি পানির উৎস ব্যবস্থার জন্য এই প্রকল্প নেয়া হয়েছে। সূত্র আরো জানায়, বিশুদ্ধ ও নিরাপদ পানির জন্য সরকার দেশের ৫২ জেলায় পানির গুণগত মান পরীক্ষায় ‘পানি পরীক্ষাগার’ স্থাপনেরও সিদ্ধান্ত নিয়েছে। টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) অর্জনের জন্য নিরাপদ পানি সরবরাহ নিশ্চিত করার জন্যই প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। কারণ দেশের অধিকাংশ এলাকায় বিশুদ্ধ পানির স্বল্পতা রয়েছে। পরীক্ষা করে নিরাপদ পানি সরবরাহ নিশ্চিত করাও চলমান প্রকল্পের মূল উদ্দেশ্য। নিরাপদ পানি সরবরাহ নিশ্চিত করার জন্য জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদফতরের আওতায় ওসব পানি পরীক্ষাগার স্থাপনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হলে সমগ্র দেশে নিরাপদ পানি সরবরাহ নিশ্চিত করা সম্ভব হবে। সেজন্যই পানি পরীক্ষাগার নেই তেমন ৫২টি জেলা সদরে ৫২টি নতুন পানি পরীক্ষাগার স্থাপন করা হচ্ছে। কারণ পানি পরীক্ষার সুবিধা সৃষ্টির মাধ্যমে জনসাধারণ নিরাপদ পানি সম্পর্কে নিশ্চিত এবং পানিবাহিত নানাবিধ রোগ থেকে মুক্ত থাকা সম্ভব হবে। তাতে নাগরিক সুবিধা বাড়বে। যে ৫২টি জেলায় ওই পরীক্ষাগার স্থাপন করা হবে তার মধ্যে ঢাকা বিভাগের ১১টি জেলা, চট্টগ্রাম বিভাগের ৯টি জেলা, রাজশাহী বিভাগের ৬টি জেলা, খুলনা বিভাগের ৮টি জেলা, ময়মনসিংহ বিভাগের ৩টি জেলা, বরিশাল বিভাগের ৫টি জেলা, সিলেট বিভাগের ৩টি জেলা ও রংপুর বিভাগের ৭টি জেলা রয়েছে। ঢাকা বিভাগের জেলাগুলো হচ্ছে নরসিংদী, শরীয়তপুর, নারায়ণগঞ্জ, টাঙ্গাইল, কিশোরগঞ্জ, মানিকগঞ্জ, মুন্সীগঞ্জ, রাজবাড়ী, মাদারীপুর, গোপালগঞ্জ, ফরিদপুর। চট্টগ্রাম বিভাগের জেলাগুলো হচ্ছে ফেনী, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, রাঙ্গামাটি, বান্দরবান, চাঁদপুর, লক্ষ্মীপুর, চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, খাগড়াছড়ি। ময়মনসিংহ বিভাগের ৩টি জেলা হচ্ছে শেরপুর, জামালপুর, নেত্রকোনা। বরিশাল বিভাগের ৫ জেলা হচ্ছে ঝালকাঠি, পটুয়াখালী, পিরোজপুর, ভোলা, বরগুনা। রাজশাহী বিভাগের জেলাগুলো হচ্ছে সিরাজগঞ্জ, পাবনা, নাটোর, জয়পুরহাট, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, নওগাঁ। সিলেট বিভাগের জেলাগুলো হচ্ছে মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ, সুনামগঞ্জ। খুলনা বিভাগের ৮টি জেলা হচ্ছে যশোর, সাতক্ষীরা, মেহেরপুর, নড়াইল, চুয়াডাঙ্গা, কুষ্টিয়া, মাগুরা, বাগেরহাট। রংপুর বিভাগের জেলাগুলো হচ্ছে পঞ্চগড়, দিনাজপুর, লালমনিরহাট, নীলফামারী, গাইবান্ধা, ঠাকুরগাঁও, কুড়িগ্রাম। বিভাগীয় সদরগুলোর মধ্যে একমাত্র চট্টগ্রাম এই প্রকল্পের মধ্যে রয়েছে। বাকি ৭ বিভাগের বিভাগীয় সদর জেলা নেই। প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হলে সারাদেশে নিরাপদ পানি সরবরাহ নিশ্চিত হবে। এদিকে এ প্রসঙ্গে প্রকল্প পরিচালক ও জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদফতরের অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী তুষার মোহন সাধু খান জানান, প্রকল্পে ১২টি উপজেলায় অফিস ভবন নির্মাণ কাজ প্রায় শেষ পর্যায়ে রয়েছে। এই প্রকল্পে অগভীর নলকূপ (ব্যাস ১ দশমিক ৫ ইঞ্চি) ৯০ হাজার ৬৩৬টি, গভীর নলকূপ এক লাখ ২৩ হাজার ৮৭৭টি, সাবমার্সিবল পাম্প ও জলাধারসহ অগভীর নলকূপ (৩ ইঞ্চি ব্যাস) ২ লাখ ৬ হাজার ৬৬৪টি, সাবমার্সিবল পাম্প ও জলাধারসহ গভীর নলকূপ (সাড়ে ৪ ইঞ্চি ব্যাস) এক লাখ ৭০ হাজার ২২২টি, রিংওয়েল ৩ হাজার ৩৭৯টি, রেইন ওয়াটার হারভেস্টিং ইউনিট ৩ হাজার ২১০টি, রুরাল পাইপড ওয়াটার সাপ্লাই স্কিম ৪শ’ ৯১টি, আর্সেনিক আয়রন রিমোভ্যাল প্ল্যান্ট (ভ্যাসেল টাইপ) ২ লাখ ৯ হাজার ৫৭০টি, সোলার পিএসএফ ৩শ’ ২০টি ও কমিউনিটি ভিত্তিক পানি সরবরাহ ইউনিট ৮ হাজার ৮৩৮টি স্থাপন করা হবে। প্রকল্পটি ২০২৫ সালের জুনে শেষ হবে। এটি সরকারের একটি অগ্রাধিকার প্রকল্প। নির্বাচনী অঙ্গীকার হিসেবে প্রকল্পটি দ্রুত বাস্তবায়ন কাজ চলছে। ইতিমধ্যে প্রাথমিক কাজ অনেক দূর এগিয়ে গেছে। বাকি কাজও দ্রুত করার জন্য ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। ডিজিটাল পদ্ধতিতে প্রকল্পের কাজ মনিটর করা হচ্ছে। একটি এ্যাপসের মাধ্যমে সারাদেশের কাজ মনিটর করা হচ্ছে। কোথায় কাজ কাজ কতো দূর এগিয়েছে বা কি হচ্ছে তা হেড অফিস থেকেই দেখা যাচ্ছে। ফলে কাজে ফাঁকি দেয়ার কোনো সুযোগ নেই।
Leave a Reply